ভূমিকাঃ
১ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস। এই দিনটি (১৫ আগস্ট ১৯২৫ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা) স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায় । ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে এই দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর ৪৮তম ‘জেল হত্যা দিবস’ পালিত হবে।
বিচার প্রক্রিয়াঃ
জেল হত্যার পরদিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর ১৯৭৫ তৎকালীন কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। তবে দীর্ঘ ২১ বছর এ বিচার প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৫ অক্টোবর ১৯৯৮ এ মামলায় ২৩জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০ অক্টোবর ২০০৪ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মতিউর রহমান মামলার রায়ে ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫-৩ নভেম্বর ১৯৭৫)
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধানতম পুরুষ, যার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নয় (০৯) মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দেন।
তিনি ১৯৫৭ সালে খ্যাতিমান রাজনীতিক, সু-সাহিত্যিক ও পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে হারিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এ পদে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৬৪-৭২ তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র, আন্দোলন শুরু হলে আইয়ুব সরকার আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার পর তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির (DAC) অন্যতম কর্ণধার। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথমে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এবং পরে ১০- ১৩ মার্চ দুদফা বৈঠক হয়। তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের অন্যতম নেতা হিসেবে এ বৈঠকে যোগদান করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ (২৩ জুলাই ১৯২৫-৩ নভেম্বর ১৯৭৫ )
তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ সরকার মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী সরকার নামে অধিক পরিচিত ছিল একজন সৎ, মননশীল ও মেধাবী রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট পেশ করেন এবং প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনের বক্তৃতায় তিনি দল, সরকার এবং নেতা ও কর্মীদের মাঝে দূরত্ব দূর করে, সংগঠন এবং সরকারের মাঝে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ ৩০ বছরের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীকে ভুল বুঝেন। ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন । ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। এ কারাগারেই ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ বন্দি অবস্থায় ঘাতকের বুলেটে তিনি নিহত হন।
এ এইচ এম কামারুজ্জামান (২৬ জুন ১৯২৬ – ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ )
আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন গঠিত অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন।
তিনি ২৬ জুন ১৯২৬ বর্তমান নাটোর জেলার বাগাতিপাড়ার নূরপুর গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল রাজশাহী জেলার কাদিরগঞ্জ মহল্লায়। তিনি বনেদি জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর পিতা আবদুল হামিদ ও মাতা বেগম জেবুন্নিসা। ১২ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। তাঁর ডাকনাম ছিল হেনা। লেখাপড়ার শুরু রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। তাঁর ফুপা রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে যাবার সময় কামারুজ্জামানকেও সাথে করে নিয়ে যান এবং চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন । তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্স পাশ করেন। এরপর তিনি রাজশাহী আইন কলেজ হতে এলএলবি পাশ করে ১৯৫৬ সালে রাজশাহী জজকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
১৯৭০ সালের নভেম্বরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণকার্যে সরকারের অনীহা এবং ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভের পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা ইত্যাদি কারণে বাঙালিদের মনে অসহিষ্ণুতা দেখা দেয়। বাঙালিরা তখন শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এরই প্রেক্ষিতে ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ রাতে পাকিস্তান সরকার নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি নিধনের উদ্দেশ্য সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়, যা ইতিহাসে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত। এই কুখ্যাত গণহত্যার সময় পাকিস্তানি বাহিনী শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি এর পূর্বেই তার দলের নেতাকর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলেছিলেন। তাই তিনি শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ ও আরো কয়েকজন নেতাকে নিয়ে বগুড়া হয়ে কলকাতা চলে যান। সেখানে তার সাথে তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য নেতাকর্মীর দেখা হয়। ওখানে তারা সকলে মিলে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। আর সবার সিদ্ধান্তে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ গঠিত হয় প্রথম অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমান মেহেরপুর জেলা) সীমান্তবর্তী এলাকা বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তীতে মুজিবনগর নামে পরিচিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ বৈদ্যনাথতলার নাম মুজিবনগর রাখেন) শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
নবগঠিত মুজিবনগর সরকারে তাকে স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কামারুজ্জামান ছিলে কঠোর পরিশ্রমী। তিনি ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে মুক্তাঞ্চল শরণার্থী শিবির ও সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করতেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে ঐ সময় কামারুজ্জামানস আরো তিন নেতাকে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি করা হয়। বছরেরই ৩ নভেম্বর ভোর সাড়ে চারটায় কেন্দ্রীয় কারাগারে অভ্যন্তরে তাদেরকে কিছু সেনা সদস্য নির্মমভাবে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয় শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম পাওয়া যায় এবং বিশেষ করে ডানদিকের পাঁজরে এব ডান হাতের কনুইতে বড়ো রকমের ক্ষত চিহ্ন পাওয়া যায়।
মুহাম্মদ মনসুর আলী (১৬ জানুয়ারি ১৯১৯–৩ নভেম্বর ১৯৭৫)
মুহাম্মদ মনসুর আলী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ।
তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের কুড়িপাড়ায় ১৬ জানুয়ারি ১৯১৯ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হরফ আলী সরকার। পড়াশোনা শুরু করেন কাজিপুরের গান্ধাইল হাইস্কুলে। এরপর তিনি সিরাজগঞ্জ বিএল হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৪১ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৫ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন অর্থনীতিতে এম এ এবং ‘ল’ পাশ করেন। এলএলবি-তে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন তিনি। ১৯৫১ সালে আইন ব্যবসা শুরু করেন পাবনা জেলা আদালতে। তিনি পাবনা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন ।
২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলে মনসুর আলী গ্রেপ্তার এড়াতে চলে যান সোবহানবাগ কলোনিতে। এখান থেকে তিনি কেরানীগঞ্জ হয়ে কুড়িয়াপাড়া যান তাঁর মাইনকার চর হয়ে তিনি কলকাতা পরিবারের সাথে দেখা করতে। এরপর চলে যান ভারতে। আসামের গমন করেন। ভারতে আশ্রয় নেওয়া দলীয় হাই কমান্ডের অন্য নেতারা মিলে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে অন্য নেতাদের সাথে দেখা ও যোগাযোগ হয় তাঁর। এরপর গঠন করেন মুজিবনগর সরকার। নবগঠিত সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে মন্ত্রিত্ব হারান ও কারারুদ্ধ হন। ৩ প্রবেশকারী সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় ব্যক্তির হাতে গুলিবিদ্ধ নভেম্বর ১৯৭৫ কারাগারে প্রচলিত নিয়ম অগ্রাহ্য করে হয়ে নিহত হন।